জেনে নিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আবিদুর চৌধুরীর অবিশ্বাস্য সাফল্যের গল্প, যিনি অ্যাপলের সবচেয়ে পাতলা আইফোন Air-এর ডিজাইনার। কীভাবে তিনি এই স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছালেন?
সম্প্রতি উন্মোচিত হয়েছে অ্যাপলের নতুন চমক iPhone Air, যা তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে পাতলা আইফোন। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই আইফোনটির মূল ডিজাইনার একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত? তার নাম আবিদুর চৌধুরী। তার এই সাফল্য শুধু প্রযুক্তি বিশ্বে নয়, বরং বাংলাদেশের তরুণদের জন্যও এক দারুণ অনুপ্রেরণা। প্রযুক্তি বিশ্বে বাংলাদেশি মেধাবীদের অবদান বরাবরই প্রশংসনীয় এবং আবিদুর চৌধুরী সেই তালিকায় এক নতুন নাম। তার এই অর্জন প্রমাণ করে, মেধা এবং কঠোর পরিশ্রম থাকলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও শীর্ষে পৌঁছানো সম্ভব।
আবিদুর চৌধুরী কে?
অ্যাপল এমন একটি কোম্পানি যেখানে কাজ করা অনেকেরই স্বপ্ন। কিন্তু এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। আবিদুর চৌধুরী তাদেরই একজন। তিনি লন্ডনে জন্মগ্রহণ করলেও তার শেকড় বাংলাদেশের সাথে গভীর ভাবে যুক্ত। তার পরিবার থেকে তিনি কঠোর পরিশ্রমের মূল্যবোধ এবং উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার শিক্ষা পেয়েছেন।
জন্ম ও শৈশব: আবিদুরের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা লন্ডনে। তার শৈশব থেকেই তিনি বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্য নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন। খেলনা গাড়ি ভেঙে তার ভেতরের মেকানিজম বোঝা থেকে শুরু করে পুরোনো রেডিও ঠিক করা—এসবের মাধ্যমেই তার মধ্যে একজন ডিজাইনারের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়। তার এই কৌতূহলই তাকে পরবর্তীতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করতে অনুপ্রাণিত করে।
শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের শুরু: লন্ডনের নামকরা সেন্ট্রাল সেন্ট মার্টিন্স (Central Saint Martins) থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করেন আবিদুর। এই সময়ে তিনি বিভিন্ন ডিজাইন প্রজেক্টে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তার লক্ষ্য ছিল এমন পণ্য তৈরি করা যা মানুষের জীবনকে সহজ এবং সুন্দর করে তুলবে। শিক্ষার পাশাপাশি তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করেন, যা তার পেশাগত দক্ষতা শাণিত করতে সাহায্য করে। এই সময়টা ছিল তার ক্যারিয়ারের জন্য সঠিক বিষয় নির্বাচন-এর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যাপলে তার পথচলা
অ্যাপলের মতো একটি কোম্পানিতে যোগ দেওয়াটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। এর জন্য প্রয়োজন অসাধারণ সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং নিরলস পরিশ্রম। আবিদুর চৌধুরীর মধ্যে এই সব গুণই ছিল।
স্বপ্নের কোম্পানিতে যোগদান: ২০১৯ সালে তিনি অ্যাপলের ডিজাইন টিমে যোগ দেন। তার প্রথম দিকের কাজগুলো ছিল বিভিন্ন আনুষঙ্গিক পণ্য নিয়ে, যা তাকে অ্যাপলের ডিজাইন ফিলোসফি বুঝতে সাহায্য করে। ধীরে ধীরে তিনি বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে যুক্ত হন। তার কাজ, সৃজনশীলতা এবং বিশদ মনোযোগ তাকে অ্যাপলের শীর্ষ ডিজাইনারদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
কেন তিনি একজন সফল ডিজাইনার?: আবিদুরের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। তিনি শুধু একটি পণ্যকে সুন্দরভাবে ডিজাইন করেন না, বরং এর পেছনের কার্যকারিতা, ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন। তার ব্যক্তিগত শখ, যেমন পুরানো জিনিসপত্র সংগ্রহ এবং সেগুলোকে নতুনভাবে সাজানো, তাকে নিত্যনতুন ধারণা পেতে সাহায্য করে। তিনি বিশ্বাস করেন, একজন ডিজাইনারের কাজ শুধু নতুন কিছু তৈরি করা নয়, বরং বর্তমানকে আরও উন্নত করা।
একটি ডিজাইনারের চোখে আইফোন এয়ার
আবিদুর চৌধুরীর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট ও লিংকডইন প্রোফাইল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, তিনি প্রায়শই বলেন যে তার কাজ হলো “মানুষের জীবনকে সহজ এবং আনন্দময় করে তোলা।” আইফোন এয়ার-এর ডিজাইন নিয়ে তিনি বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি ফোন তৈরি করা যা হাতে নিতেই ব্যবহারকারী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। শুধু পাতলা করা নয়, এর প্রত্যেকটি কার্ভ, ওজন এবং ম্যাটেরিয়াল সিলেকশন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে এটি একটি ‘আনন্দের পণ্য’ হয়ে ওঠে।” তার এই শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিই আইফোন এয়ারকে অন্যান্য মডেল থেকে আলাদা করে তুলেছে।
আইফোন এয়ার: ডিজাইনের পেছনের গল্প
অ্যাপলের নতুন সংযোজন iPhone Air এখন পর্যন্ত তৈরি সবচেয়ে পাতলা আইফোন। এটি শুধু একটি ফোন নয়, বরং একটি প্রকৌশলগত ও শৈল্পিক নিদর্শন।
সবচেয়ে পাতলা আইফোন: একটি নতুন দিগন্ত: আইফোন এয়ার-এর সবচেয়ে বড় চমক হলো এর পাতলা গঠন। এর পুরুত্ব মাত্র ৬.১ মিলিমিটার, যা আইফোন ১৫ প্রো-এর চেয়ে প্রায় ২৫% পাতলা। টাইটানিয়াম ফ্রেম এবং নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তির কারণে এটি ওজনেও অনেক হালকা। এটি টেকনোলজি এবং উদ্ভাবনী পণ্য -এর এক দারুণ উদাহরণ।
ডিজাইনের পেছনের ভাবনা
একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনার হিসেবে আবিদুর চৌধুরীকে একাধিক ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রথমে তিনি স্কেচিং এবং আইডিয়া তৈরি করেছেন। এরপর সেই আইডিয়াকে থ্রি-ডি মডেলে রূপান্তর করে প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল (যেমন, টাইটানিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম) নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সবচেয়ে উপযুক্তটি বেছে নেওয়া হয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই নিশ্চিত করে যে ডিজাইনটি শুধু দেখতে সুন্দর নয়, বরং ব্যবহারিক এবং টেকসইও।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বিদ্যুৎসাশ্রয়ী প্রযুক্তি: আইফোন এয়ার শুধু পাতলা নয়, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-ভিত্তিক নতুন ক্যামেরা প্রযুক্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি লাইফ নিয়ে এসেছে। এর ক্যামেরা সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি ও ভিডিওর সেটিংস পরিবর্তন করতে পারে, যা ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতাকে সহজ করে তোলে।
অ্যাপলের ডিজাইন টিমে যোগদানের শর্ত
অ্যাপলের ডিজাইন টিমে কাজ করার জন্য সাধারণত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, ৫-১০ বছরের পেশাদার অভিজ্ঞতা এবং একটি শক্তিশালী পোর্টফোলিও প্রয়োজন হয়। অ্যাপলের অফিসিয়াল ক্যারিয়ার পেজ অনুসারে, তারা এমন প্রার্থীদের খোঁজ করে যারা শুধু নকশা করতে পারে না, বরং সমস্যা সমাধানে সৃজনশীল এবং দলে কাজ করতে পারদর্শী।
আবিদুর চৌধুরীর সাফল্য: বাংলাদেশের জন্য এক দারুণ অনুপ্রেরণা
আবিদুর চৌধুরীর গল্প শুধু একজন সফল ডিজাইনারের গল্প নয়, এটি লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর জন্য এক নতুন দিগন্ত। তার জীবন প্রমাণ করে, দেশের বাইরে থেকেও নিজেদের মেধা এবং পরিচয়কে তুলে ধরা সম্ভব। এটি আমাদের দেশের তরুণদের অনুপ্রাণিত করে আন্তর্জাতিক মানের কারিগরি দক্ষতা অর্জনে এবং স্বপ্নের ক্যারিয়ার গড়ার পথে এগিয়ে যেতে। তার এই সাফল্য, বাংলাদেশের জন্য এক দারুণ অনুপ্রেরণা। তার মতো সফল ব্যক্তিদের দেখে আমাদের তরুণ প্রজন্ম আরও বেশি করে ক্যারিয়ার গাইড ও চাকরির সুযোগ সম্পর্কে জানতে উৎসাহী হবে।